×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • দাউ দাউ পুড়ছে ভারতমাতার বেটিরা

    শুভস্মিতা কাঞ্জী ও বিতান ঘোষ | 05-10-2020

    দহন। শরীরের নাকি দেশের?

    আমি চাইনা আমার সন্তান হোক। বিশেষত মেয়ে। এই দেশ মেয়েদের জন্য না।

    এনকাউন্টার করে দেওয়া হোক এদেরও।

    আর কত?’

     

    এ হেন স্টেটাসে সোশাল মিডিয়া ভরে গেছে হাথরাসের ঘটনার পরকিন্তু সোশাল মিডিয়ায় এসব লিখে বা মুখ কালো কাপড়ে বেঁধে মোমবাতি মিছিল করলেই কি এই ধর্ষণ বন্ধ হবে? সোশাল মিডিয়া জুড়েই রয়েছে এমন অজস্র মন্তব্য, যার মধ্যে প্রচ্ছন্ন ধারণা এই যে, মহিলা মানেই তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সম্ভোগ করা যায়। এই ধারণার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ ছাপোষা মানুষের একাংশের মধ্যে। সামাজিক মাধ্যমের আয়নায় প্রতিফলিত মানসিকতা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, কেন হাথরাস বা কামদুনি ফিরে ফিরে আসে বারবার।

     

    বেকারদের জন্য যৌনপল্লী ভাতা?

    দেশের শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু হাথরস কান্ডের পরই সোশাল মিডিয়ায় বলেছেন, জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় জিনিস সেক্সজরুরি তালিকায় সেক্স বা যৌনতা রয়েছে দুই নম্বরে, খাদ্যের ঠিক পরেই। অর্থাৎ বাসস্থান, বস্ত্র না হলেও চলবে। কিন্তু তিনি এতটুকু বলেই থামেননি। তাঁর যুক্তি, বেকারত্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাকি ধর্ষণ বাড়বে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেন বলুন তো? কারণ যৌনতা তো জরুরি বিষয়, চাহিদাও বটে— যাকে দমন করা যায় না, কিন্তু এদিকে চাকরি নেই বেকার ছেলের বিয়ে হয় না! এবং ভারতে আইনত কোনও মেয়েকে সম্ভোগ করতে হলে তার সামাজিক লাইসেন্স হল বিয়ে’, এবং সেটা হচ্ছে না বলে ছেলেরা রেপ করছে। কিন্তু কাটজু সাহেব কি জানেন না চাহিদামেটানোর জন্য অন্য উপায় আছে, জায়গা আছে? তাহলে, নৃশংসতার শিকার এই নিরপরাধ মেয়েগুলোকে কেন হতে হবে? অবশ্য এর জন্য তো টাকা প্রয়োজন, সেটা কে দেবে? আচ্ছা, কাটজু সাহেব কি সরকারকে বলে ভাতার ব্যবস্থা করতে পারেন না? 


    ঋতুমতী হলে আর ধর্ষণ নয়!

    এ তো গেল বিচারপতি সাহেবের বক্তব্য, সমাজের গণ্যমান্য মানুষ ওইরকম একটু আধটু বলতেই পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কী বক্তব্য? একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম ডকুমেন্টারি বানিয়েছিল, গোবলয়ের মানুষদের মন্তব্য নিয়ে, যে ধর্ষণ নিয়ে তাদের কী ধারণা। এক একটি মন্তব্য শুনে শিউরে উঠলেও স্পষ্টতই বোঝা যায়, সেখানেই কেন ধর্ষণ এবং নৃশংসতার হার বেশি। কিছু মন্তব্য তুলে ধরছি সেই ডকুমেন্টারি থেকে। প্রথমত, ‘14-15 বছরের বেশি কোনও মেয়ের ধর্ষণ হলে, সেটা আর ধর্ষণ থাকে নাযদিও কথাটার যুক্তিগ্রাহ্যতা বোধগম্য হয়নি, তাও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হয়, আসিফা বা এই দু'দিন আগে উত্তরপ্রদেশের আজিমগঞ্জে ধর্ষনের শিকার হল যে বাচ্চাটি তাদের বয়স কত? কী দোষ করেছিল তারা? ছোট জামা পরেছিল? জিন্স পরেছিল? কারণ সেই ডকুমেন্টারিতে স্কুল পড়ুয়া কিছু বালকের বক্তব্য ছিল, ‘মেয়েরা জিন্স পরে ছেলেদের উত্তেজিত করে।কেউ কেউ আবার তো আফসোস করেন, যে কেন সহজ সরল মেয়েগুলোর ধর্ষণ হয়! সাজাদিতে হলে উদ্ধত, দেমাকি মেয়েদের দেওয়া উচিত। ঠিকই তো ঠিকই তো! আহা কী উচ্চ বিচার।

     

    গুরু গোলওয়ালকারই লাইসেন্স দিয়ে গেছেন!

    কিন্তু আপনি কী ভাবছেন এমন ধারণা শুধু ছেলেদেরই? তাহলে খুব ভুল ভাবছেন, মহিলারাও বাদ যান না। বাদ যান না, সংঘী গুরুরাও। তাঁদের বাণীশুনলে বোঝা যাবে গোবলয়ের লোকজনের চিন্তাধারা এত উর্বর কেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দ্বিতীয় সরসংঘচালক গোলওয়ালকারের মতে, ‘দলিত রমণীদের সম্ভোগ করা সংঘীদের জন্মগত অধিকার।দলিত নারীর প্রথম সন্তান ব্রাহ্মণ পুরুষের ঔরসজাত হলে, সে নাকি বুদ্ধিবৃত্তিতে ব্রাহ্মণের সমতুল হবে। মানে ভাবনার দৌড়টা একবার ভাবুন! কেন হে মেয়েটি কি সেই অনুমতি দিয়েছে? না আপনাদের স্পর্শেই সে উঁচুজাতের হয়ে যাবে? মহাভারতের যুগে তবু ব্রাহ্মণ পরাশররা মেছুনি সত্যবতীদের অনুমতি নিয়ে তাদের সঙ্গে সঙ্গম করত, কিন্তু সংঘের এসব গুরুরা তো এটাকে অধিকারের স্থানে উন্নীত করেছেন। এই দেশে মেয়ে হয়ে জন্মানো তো অপরাধ বটেই, আর সে যদি নিচু জাতের হয় বা রাতবিরেতে একা বেরোনোর মতো দুঃসাহসদেখায়, তবে তো আর কথাই নেই! শিক্ষাদেওয়ার জন্য হাত ভাঙা, পা ভাঙা, জিভ কাটা, রড ঢুকিয়ে দেওয়া কতই না উপায় আছে।

     

    ধর্ষণের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব নারীরই!

    আপনার কি এসব পড়ে খুব রাগ হল, গা'টা জ্বালা জ্বালা করল? বিরক্ত লাগল? দাঁড়ান দাঁড়ান, এখনও তো গোরক্ষনাথ মঠের সেই মহন্তের কথাই আপনাদের বলা হয়নি। আরে বাবা যোগীজী, যোগী আদিত্যনাথের কথা বলছি। 2017 সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘মেয়েদের আবার স্বাধীনতার প্রয়োজন কেন? মেয়েরা স্বাধীন হলে সংসারের শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। পুরুষেরা মহিলাদের মতো ক্ষমতা অর্জন করলে তারা ঈশ্বর হয়ে ওঠে, কিন্তু উল্টোটা হলে মেয়েরা রাক্ষস হয়ে যায়।একটা স্লো ক্ল্যাপ দিন, উহু ওঁর বক্তব্যের জন্য নয়, আমাদের নিজেদের বিচারবুদ্ধির জন্য। কারণ আপনি, আমিই ভোট দিয়ে এদের ক্ষমতার মসনদে বসিয়েছি। তাই এই পুরস্কার যে আমাদেরই প্রাপ্য। দেশের বাকপটু প্রধানমন্ত্রী এখনও হাথরসের ঘটনা নিয়ে কোনও বক্তব্যই রাখেননি। তাঁর দলের বড়-মেজ-ছোট, সবরকমের নেতারা ময়দানে নেমে পড়েছেন। তারা উপযাচক হয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন, কী কী পদক্ষেপে ধর্ষণটাকে আটকানো যায়। হেঁহেঁ, ভাববেন না যে, শাসকদলের নেতারা এই পদক্ষেপগুলো শাসক শিবিরকে নিতে বলছেন। নিতে বলছেন ধর্ষণের শিকার কিংবা ধর্ষণের আশঙ্কায় থাকা মেয়েদের। মেয়েদের বাবা-মায়েদেরও কিন্তু বিশাল দায়িত্ব। পরপুরুষের সামনে আখাম্বা ঘোমটা টেনে থাকা, সূর্য পশ্চিমে ঢললেই ঘরের খিল এঁটে ঢুকে যাওয়া— তাদের এই প্রাথমিক সংস্কারের পাঠটুকু বাবা-মাকেই দিতে হবে।

     

    ওটা কী জ্বলছে?

    আবার লড়াই হবে, আবার মানুষ পথে নামবে, মোমবাতি মিছিল হবে, সোশাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগড়ে পড়বে, বছরের পর বছর ধরে কেস চলবে, তাতেও দোষীদের শাস্তি হবে কিনা জানা নেই। এখন জেলাশাসক নির্যাতিতার বাড়ি গিয়ে 25 লক্ষ টাকার গরমদেখাচ্ছেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে বন্দুকের নল দেখতেও হতে পারে তাদের। তাতেও যদি পরিবারটি মেয়ের ন্যায়বিচার পাওয়ার প্রত্যাশায় লড়ে যায়? উন্নাওয়ের নির্যাতিতার পরিবারের মতো দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হবে না তো তাদের? আমাদের দায় অবশ্য খুব বেশি নেই। আমরা মোমবাতি জ্বালাব, সোশাল মিডিয়ায় জাস্টিস ফর ওমুক লিখব। কিন্তু মোমবাতির মোম গলার আগেই আরও অনেক ঘটনা ঘটে যাবে— যেগুলো হয়তো আমাদের জানাই হবে না, জানতে দেওয়া হবে না। জাস্টিস ফর-এর পর নামগুলো দ্রুত বদলে যেতে থাকবে। আর কিছু মানুষ ধর্ষণকে জাস্টিফাই করে যাবেন। অন্ধকারে জ্বলে ওঠা চিতায় হাথরসের নির্যাতিতার দলা পাকানো শরীরটা দেখে মনে হচ্ছিল এক তপস্বী যেন ধ্যানে বসেছেন। মনে প্রশ্ন জাগছিল, ‘রাত্রির তপস্যা, সে কি আনিবে না দিন?’

     

     


    শুভস্মিতা কাঞ্জী ও বিতান ঘোষ - এর অন্যান্য লেখা


    মোমবাতি মিছিল হবে, সোশাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগড়ে পড়বে, বছরের পর বছর ধরে কেস চলবে

    দাউ দাউ পুড়ছে ভারতমাতার বেটিরা-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested