গুজরাটের মৃত্যু নথি যে সত্যি কথা বলছে: মহামারী শুরুর পর থেকে 2.8 লক্ষেরও বেশি অতিরিক্ত মৃত্যুর অনুমান করা হচ্ছে।
কোভিড-19 এর কারণে মাত্র 10,075 জন মারা গেছে বলে দাবি করেছে সরকার। কিন্তু সরকারি মৃত্যু-নথি যাচাই করে দেখা গেছে, 68টি পৌরসভায় আদতে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার 6 শতাংশের বেশি লোক মারা গেছে।
গুজরাটের আমরেলি শহরের দু'টি শ্মশানের একটি হল কৈলাশ মুক্তি ধাম, বর্তমানে সেখানকার চারটি চুল্লিরই ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। লোহার গ্রিল, যা মৃতদেহগুলিকে ধরে রাখত সেগুলো বিরামহীনভাবে আগুন থাকার ফলে গলে গিয়েছে।
শ্মশানের এক স্বেচ্ছাসেবক মগনভাই 2021-এর এপ্রিল-মে মাসে যখন কোভিড-19 এর প্রাদুর্ভাব শহরটিকে ধ্বংস করছিল, তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘টানা এক মাস ধরে 24 ঘণ্টাই চিতাগুলো জ্বলছিল।' অনবরত মৃতদেহ আসতে থাকায় কাঠের সরবরাহ শেষ হয়ে গিয়েছিল, এবং এই মর্মে শ্মশানের স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন। সেই স্বেচ্ছাসেবকদের প্রায় বিশজনের দলের তিনজন সদস্য এই ভাইরাসে মারা যান।
দুই মাসে, দু’টি শ্মশানে 1,161টি শব দাহ করা হয়েছিল। যেহেতু এটিই তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল, তাই বাকি দেহগুলি পার্শ্ববর্তী গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এবং স্থানীয় মুসলিম কবরস্থানে আরও 100 জনকে কবর দেওয়া হয়; এত মৃতদেহ আসছিল যে কবর খননের জন্য কবরখননকারীদের ডাকা হয়েছিল।
(আমরেলিতে মাত্র একটি শ্মশানেই এপ্রিল ও মে মাসে সাড়ে সাতখানা রেজিস্টার ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি রেজিস্টারে 100টি করে পৃষ্ঠা থাকে)
বাকি ভারতের মতো কোভিড-19 এর দ্বিতীয় তরঙ্গ গুজরাতের প্রায় প্রতিটি শহরের উপর দিয়েই বয়ে গিয়েছিল, যার ফলে প্রচুর মৃত্যু ঘটেছিল। গুজরাত হাইকোর্ট সঠিক তথ্য প্রকাশের জন্য রাজ্যকে চাপ দেওয়া সত্ত্বেও সরকার দাবি করেছে যে, মহামারীর দু’টি তরঙ্গ মিলিয়ে মাত্র 10,075 জন (এই রিপোর্ট লেখার সময়) মারা গিয়েছে। এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, গুজরাত ‘কোভিড সংকট ভালভাবে সামাল দিয়েছে।’
সরকারী রেকর্ড থেকে এটা প্রমাণিত যে, রাজ্য সরকার মৃত্যুর সংখ্যা এবং ধ্বংসের প্রকৃত চিত্রের উপর একটি মোটা কাফন টেনে আসল তথ্য লুকিয়েছে।
রিপোর্টার্স কালেকটিভ রাজ্যের 170টি পৌরসভার মধ্যে 68টি থেকে মৃত্যুর রেজিস্টারের কপি হাতে পেয়েছে। এই রেজিস্টারেই মৃত্যু এবং মৃতদের বিবরণ প্রথমে কর্মকর্তারা লিপিবদ্ধ করেন। আমরা জানুয়ারী 2019 থেকে এপ্রিল 2021 এর মধ্যে হাতে ভরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার রেজিস্টারের কপি সংগ্রহ করেছি।
মৃত্যুর রেজিস্টারগুলির বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, 68টি পৌরসভায়, 2019 সালে, অর্থাৎ মহামারী হওয়ার আগের বছরের তুলনায় মার্চ 2020 এবং এপ্রিল 2021 এর মধ্যে 16,892 জন অতিরিক্ত মানুষ বিভিন্ন কারণে মারা গেছে। এই 68টি পৌরসভায় রাজ্যের 6 শতাংশ মানে 6.03 কোটি জনসংখ্যার বসবাস। সরল সমানুপাতিকতা ব্যবহার করে আমরা অনুমান করছি যে মহামারীটি গোটা রাজ্যে কমপক্ষে 2.81 লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সরকারী হিসেবের 27গুণেরও বেশি।
হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথের এপিডেমিওলজির অধ্যাপক, ডক্টর ক্যারোলিন বুকি বলেন, ‘এই পৌরসভাগুলির অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা থেকে বোঝা যায় যে সংশ্লিষ্ট অফিসিয়াল বা সরকারী তথ্যে কোভিড-19 মৃত্যুর সংখ্যায় আসল মৃত্যুর সংখ্যার একটি বড় অংশ অনুপস্থিত।’
এই ‘অতিরিক্ত মৃত্যু’ হল কর্মকর্তাদের দ্বারা কম মৃত্যু গণনার হিসাব করার একটি সহজ উপায় যা মহামারী চলাকালীন মোট মৃত্যুর সঙ্গে আগের বছরের একই সময়ে ঘটে যাওযা মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে। সমস্ত অতিরিক্ত মৃত্যু কোভিড-19 এর সাথে যুক্ত হতে পারে না। কিন্তু, হঠাৎ এভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার আর কোনও কারণ না থাকায় বিশেষজ্ঞরা এই মৃত্যুর অধিকাংশকে কোভিড-19 মহামারী এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ার জন্যই মনে করেছেন।
গুজরাটের অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে গ্রামীণ এলাকাগুলির তথ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে না, যা মোট জনসংখ্যার 57 শতাংশ, এবং যারা শহুরে এলাকার তুলনায় ন্যূনতম জনস্বাস্থ্য পায়।আমরা 2021 সালের মে মাসেরও পরিসংখ্যানও বাদ দিয়েছি, যা এই রাজ্যের এপ্রিলের থেকেও বেশি মৃত্যু দেখেছে। কারণ 68টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র তিনটিতে মে মাসের শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ডেটা ছিল।
শুধুমাত্র 2021 সালের এপ্রিল মাসে, 6 শতাংশ জনসংখ্যার পর্যালোচনার অধীনে 10,238 অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে, যা পুরো মহামারীতে গোটা রাজ্যের সরকারী পরিসংখ্যানের থেকেও 10,077 বেশি।
এই পরিমাপে, শুধুমাত্র 2021 সালের এপ্রিল মাসে রাজ্যে 1.71 লক্ষ অতিরিক্ত মৃত্যুর পূর্বাভাস ছিল। যদিও আমরা এখনও 2021-এর মে মাসের সংখ্যাগুলি জানতে পারিনি, যখন ভাইরাস সংক্রমণ তুঙ্গে ছিল। এই পৌরসভাগুলির হাজার হাজার পৃষ্ঠার মৃত্যুর রেজিস্টার সরকারের দেওয়া তথ্যকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
2011 সালের আদমশুমারি তথ্য অনুসারে সুরেন্দ্রনগর, সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের একটি জেলা, যার জনসংখ্যা 17,56,268। সরকারের মতে, এই জেলায় মোট 136 জন কোভিড-19 এ মারা গেছেন। কিন্তু মৃত্যু নিবন্ধন দেখায় যে একটি পৌরসভা, যা ওই জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় 14 শতাংশ, সেখানে 2021-এর মার্চ এবং এপ্রিল মধ্যে 1,210টি অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে।
স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও, ভারতে কোভিড-19 এর বেশিরভাগ মৃত্যু রেকর্ড করা হচ্ছে না। এটির নেপথ্যে বিভিন্ন কারণ আছে বলেই মনে করা হচ্ছে। লন্ডনের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতবিদ মুরাদ বানাজি, যিনি কোভিড-19 এর পরিসংখ্যানকে নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছেন তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে, অনিয়মিত নজরদারি একটি ভূমিকা পালন করছে।'
বানাজি আরও বলেন, ‘মনে হচ্ছে কোভিড-19 মৃত্যুর রেকর্ডিং নির্দেশিকা কিছু রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছে। উদাহরণস্বরূপ, ডেথ অডিট কমিটিগুলি কোভিড-19 রোগী, যাদের কোমর্বিডিটি ছিল তাদের মৃত্যুকে অফিসিয়াল কাউন্ট থেকে বাদ দিতে পারেন। গুজরাত সহ বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে এই বিষয়ে রিপোর্ট এসেছে।'
ভারতে, অসম্পূর্ণ মৃত্যুর রেকর্ড এবং রেকর্ডে মৃত্যুর কারণের অনিয়মিত শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে ডেটা দমন করার ফলে কোভিড-সম্পর্কিত মৃত্যুর গণনাকে অসম্ভব করে তুলেছে। কোভিড-সম্পর্কিত মৃত্যুর সরকারি তথ্যের অভাবে, বিশ্বব্যাপী বিশেষজ্ঞরা ভয়াবহতার মাত্রা বোঝার জন্য প্রক্সি হিসাবে ‘অতিরিক্ত মৃত্যুর’ ডেটা ব্যবহার করার পরামর্শ দেন।
কোভিড-19 সংক্রমণের কারণে সরাসরি মৃত্যু ছাড়াও,অতিরিক্ত মৃত্যুগুলি কোভিড-পরবর্তী সময়ে নানান কো-মর্বিডিটি থাকার কারণে ব্যাপারটাকে জটিল করে তুলতে পারে এবংবিভিন্ন উপসর্গ যেমন রক্ত জমাট বাঁধা, হার্ট অ্যাটাক এবং ফুসফুসের ফাইব্রোসিসের কারণেও তখন মৃত্যু হতে পারে।
ডক্টর বুকি বলেন, "দুর্যোগের পর মৃত্যুর সংখ্যা গণনা করা হয় ডেথ সার্টিফিকেটের উপর ভিত্তি করে।'
"এই সিস্টেম ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে। মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসার অভাব, পরীক্ষার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদির কারণে SARS-Cov-2 এর জন্য কতজনের মৃত্যু ঘটেছে সঠিকভাবে বলা যায় না। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলের জনসংখ্যার সহকারী অধ্যাপক আয়েশা মাহমুদ বলেন, ‘মহামারীগুলি জনস্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে- যার সময় মৃত্যু কেবল রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণেই হয় না, এর প্রভাব সামাজিক কার্যক্রমেও পড়ে।’
বানাজি আরও জানিয়েছেন, "প্রকৃতপক্ষে, অতিরিক্ত মৃত্যুর হার, কেস এবং মৃত্যুর বিষয়ে সরকারী তথ্যের চেয়ে বিপর্যয়ের প্রভাবের অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য পরিমাপ।’
পৌর-স্তরের ডেথ রেজিস্টারের তথ্যের ভিত্তিতে অনুমানগুলি ক্রসচেক করার জন্য, দ্য রিপোর্টার্স কালেক্টিভ একটি সম্পূর্ণ জেলা, বোতাদের শহুরে পৌরসভা এবং সমস্ত গ্রাম পঞ্চায়েতের তথ্যকে নিয়েছে।
সরকার দাবি করেছে, বোতাদে কোভিড-19 সংক্রান্ত অসুস্থতার কারণে মাত্র 42 জন মারা গেছে। কিন্তু মৃত্যুর রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে যে জেলায় মার্চ 2020 থেকে জুন 2021 এর মধ্যে 3,117 অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে-যা সরকারি সংখ্যার চেয়ে 74 গুণ বেশি।
মৃত্যুর সংখ্যা গোনা
অন্যান্য রাজ্যের মতো গুজরাতেও যে কোভিড-মৃত্যুর সংখ্যা লুকোনো হয়েছে, তা একটি স্থানীয় সংবাদপত্র প্রকাশ্যে আনে। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ যখন উত্তুঙ্গ পর্যায়ে, তখন সরকারি তরফে যে মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে কারচুপি করা হয়েছে, তা মিলিয়ে দেখা হয়েছে শ্মশান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে। রিপোর্টে পাওয়া এই তথ্য কিছুটা বিক্ষিপ্ত অসংহত হলেও বিপদের মুখে সরকারের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা সম্পর্কে আমাদের আগাম সতর্ক হতে সাহায্য করে।
পরবর্তী সময়ে সারা দেশে জন্ম ও মৃত্যুর তথ্যভাণ্ডার, সিভিক রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (CRS)-এ প্রাপ্ত তথ্যের তুলনায় গণমাধ্যমগুলি আরও বেশি কোভিড-মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করে তথ্য নবীকরণ করতে CRS-এর সময় লাগছে।
গত 4 আগস্ট কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, CRS-এর তথ্য সংগ্রহ, আগের তথ্যের সঙ্গে তুলনা, পুরনো তথ্য মুছে ফেলা, সর্বশেষে তথ্য প্রকাশ— এতগুলি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে সময় লাগে। কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, কোনও মৃত্যুর সংখ্যাই সেখান থেকে বাদ যাবে না। কারণ এই বিস্তৃত কর্মকান্ডে প্রাপ্ত যাবতীয় তথ্য সচরাচর পরের বছর প্রকাশ করা হয়।
প্রাথমিক সূত্র থেকে পাওয়া মৃত্যুর সংখ্যা সংগ্রহ, বিশ্লেষণের কাজে রিপোর্টার্স কালেকটিভ যে তিনমাস অতি সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছে, তার অন্যতম কারণ সরকারের এই দায়সারা মনোভাব। প্রসঙ্গত রিপোর্টার্স কালেকটিভ যে প্রাথমিক সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে, সেখান থেকে CRS-ও তথ্য সংগ্রহ করে।
(খেদব্রামা পৌরসভার মৃত্যু নিবন্ধনের একটি পাতা। সৌজন্যে: শ্রীগিরীশ জালিহাল / রিপোর্টার্স কালেকটিভ)
2019-20 সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, গুজরাতে 93 শতাংশ মৃত্যু নথিবদ্ধ হয়েছে। 7 শতাংশ বিভিন্ন কারণে নথিবদ্ধ হয়নি। পরিবারে কারও মৃত্যু হলে তা নথিভুক্ত করতে সময় লাগে। তারপর মৃত্যুর দিন এবং নথিভুক্তকরণের দিন রেজিস্টারে নথিভুক্ত হয়।
পৌরসভা (শহরাঞ্চলে), গ্রাম পঞ্চায়েত (গ্রামাঞ্চলে) থেকে তথ্য নিয়ে জেলাসদরে তা পরিমার্জন ও সংযোজন করা হয়। তারপর ডিজিটাল পদ্ধতিতে CRS-এ তথ্য নবীকরণ করা হলে সারা রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু যখন রাজ্য ও জাতীয় স্তরে এই তথ্যের বৈধতা পরীক্ষা কিংবা অন্য তথ্যের সমন্বয়সাধন করা হয় তখন যথেষ্ট সময় লাগে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এটা খুব ভাল যুক্তিগ্রাহ্য একটা অজুহাত দাঁড় করানোর জায়গা, যার সাহায্যে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ সহ যে নিরপেক্ষ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তার প্রকাশ তারা রাজনৈতিক কারণে স্থগিত করে দিতে পারে। এখন কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা লুকোতে একই কাজ করা হচ্ছে।
একটি কেন্দ্রীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানে জনসংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে কাজ করা এক বর্ষীয়ান আধিকারিক বলছিলেন, ‘যেহেতু CRS তথ্যের ভিত্তিতে জাতীয় স্তরেএ প্রকৃত চিত্রটা বুঝতে দু'বছর পর্যন্ত লেগে সময় লাগতে পারে, সেহেতু প্রকৃত মৃত্যুহার জানতে পৌরসভার মৃত্যু-নথিকে প্রাথমিক সূত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে CRS-এর চূড়ান্ত রিপোর্টের ওপর নির্ভর করতে হয় না।'
তথ্যের স্বচ্ছতা
রিপোর্টার্স কালেকটিভের উদ্যোগে গুজরাতের 68টি পুরসভা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে প্রতিতুলনা করে সারা দেশ জুড়ে 'অতিরিক্ত মৃত্যুর পরিসংখ্যান' প্রকাশ করা হয়। এই রিপোর্ট সংগ্রহ করার সময় গুজরাতের 100টি পুরসভা এবং অন্যান্য রাজ্যের 35টিরও বেশি পুরসভার তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়। মহামারীতে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের স্মরণ করতে, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সম্মিলিত উদ্যোগে এই তথ্য একটি অনলাইন মাধ্যমে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
গুজরাতের পুরসভাগুলি থেকে মৃত্যুহার সংক্রান্ত যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, তা হার্ভার্ডের টিএইচ চ্যান স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এর বিশেষজ্ঞদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত এই বিশেষজ্ঞরা অতীতে পুয়ের্তো রিকোর ওপরে আছড়ে পড়া ঘূর্নিঝড় মারিয়ার প্রভাবে কতজন মারা গিয়েছিলেন, তার তদন্ত করেছিলেন।
হার্ভার্ডের আপৎকালীন চিকিৎসক এবং বিপর্যয় মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ সতচিত বালসারি বলছিলেজ, ‘যে কোনও বিপর্যয়ের পর মৃত্যুহার সংক্রান্ত তথ্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই তথ্য থেকে মহামারীর চরিত্র সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। যেমন মহামারীতে কে মারা যাচ্ছেন? কীভাবে, কখন, কোথায় মারা যাচ্ছেন? এই উত্তরগুলোর ভিত্তিতেই সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারী রোধে জোরদার ব্যবস্থা নিতে পারে।'
তাঁর আরও দাবি, ‘দেশের বহু সরকার প্রকৃত তথ্য আড়াল করার ভুলটা করেছে। কিন্তু ভ্রান্ত বা আড়াল করা তথ্য জনস্বাস্থ্য রক্ষার কাজটাকেই দুর্বল করবে— বিশেষত যখন জনস্বাস্থ্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়।'
মহামারীতে ক্ষতির বহরটা বুঝতে দুটি রিপোর্টের একটি— যেটি মূলত গুজরাতের ওপর ভিত্তি করে জুন মাসে তৈরি করা হয়েছিল— তার ওপর চোখ বোলানোই যথেষ্ট। মৃত্যু সংক্রান্ত সরকারি নথি থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা বিভিন্ন শোকবার্তা থেকে যাচাই করে দেখা হয়। অধিকাংশ পুরসভার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অন্যান্য বয়সশ্রেণীর তুলনায় 50-80, এই বয়সশ্রেণীটির মৃত্যুহার হঠাৎ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে আর একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে। তা হল কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন রোগীর তুলনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী বেশি মারা গেছে।
এখান থেকেই বোঝা যাচ্ছে বাস্তবে ঠিক কী হয়েছিল।
আমরেলির সমাধিক্ষেত্রের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সংস্থা দারুল উলুম মেহবুবিয়ার সদস্য সৈয়দ মেহবুব রহমানের কথায়, ‘আমি এমন ঘটনাও দেখেছি, যেখান 60 বছর বয়সী কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে 20 বছর বয়সী কাউকে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।'
তাঁর আরও বক্তব্য, ‘অক্সিজেনের জোগান নিরবচ্ছিন্ন রাখতে নাগরিক সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে কোনও সাহায্য পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন কমিউনিটি হলগুলো থেকে মানুষ অক্সিজেন পেয়েছে, কিন্তু সেখানে কোনও চিকিৎসক রাখার বন্দোবস্ত ছিল না।'
চলতি বছরের 21 এপ্রিল আমরেলির জনৈক রেডিওলজিস্ট, ডাক্তার ভারত পাডা শ্মশানে দাঁড়িয়ে ই-মেল আইডি থেকে সিটি স্ক্যানের রিপোর্টটা মুছে দিচ্ছিলেন। তখন তাঁর সামনে তাঁর বাবাকে দাহ করা হচ্ছে। তাঁর 74 বছরের বৃদ্ধ বাবার মৃত্যুর মাত্র সাতদিন আগে কোভিডের চিকিৎসা শুরু হয়।
(আমরেলির রেডিওলজিস্ট, ডাক্তার ভারত পাডা বলছিলেন, 'আমি ভিতরে একটা পাথর বহন করছিলাম'। তাঁর 74 বছরের বৃদ্ধ বাবা কোভিড রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর সাতদিনের মাথায় মারা যান। সৌজন্যে: শ্রীগিরীশ জালিহাল / দ্য রিপোর্টার্স কালেকটিভ)
ডাক্তার পাডা তাঁর সোনোগ্রাফি ল্যাবে ফিরে গিয়েছিলেন। তাঁর ল্যাবটি শুধু শহরের তিনটি ল্যাবের অন্যতম। পরেরদিন প্রায় 15 ঘন্টার ডিউটির আগে তিনি খানিক ভারমুক্ত হয়ে, তাঁর এক ক্যামরার ক্লিনিকে রিপোর্টারকে বললেন, ‘আমি ভিতরে একটা পাথর বহন করছিলাম। আমি কোনও আবেগ অনুভূত হচ্ছে না।'
ডাক্তার পাডা অন্য অনেকের মতোই সরকারের কোভিড মৃত্যুর পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘সরকারি তরফে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাটা একই থাকবে, যেহেতু আমি মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম। কিন্তু শুধু এই মানুষগুলোই কোভিডে মারা গেছে, এমনটা কার্যত অসম্ভব।'
আমরেলি জেলার 9টি পুরসভার 6টির মৃত্যু-নথিতে দেখা যাচ্ছে, এই বছরের এপ্রিল মাসে 2019 সালের এপ্রিল মাসের তুলনায় অতিরিক্ত 1257টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এপ্রিল মাসে সরকার দাবি করে গোটা আমরেলি জেলায়, এমনকি জেলার গ্রামীণ অঞ্চল মিলিয়ে কোভিড মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র 14!
সরকারের মৃত্যু-নথি থেকে যে অতিরিক্ত মৃত্যু সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে, তা হয়তো প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যার থেকে কম। পরিবারের কারও মৃত্যু হলে তা সরকারের খাতায় নথিবদ্ধ করতে মানুষ একদিন থেকে একমাস লাগিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সরকারের খাতায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই!
Numbers:
Graph 1: 2020 সালের শুরুতে মৃত্যুর হার 2019 সালে প্রতিফলিত হয়েছিল কিন্তু এপ্রিল থেকে যখন কোভিড-19 প্রথম সংক্রামিত হতে শুরু করেছিল তখন থেকে এই ব্যবধান বাড়তে শুরু করে। সমস্ত 68 টি পৌরসভা জুড়ে সর্বাধিক সংখ্যক মৃত্যুর সংখ্যা জুলাই মাসে হয়েছিল,1228। 2021 সালে, দ্বিতীয় তরঙ্গের মধ্যে এপ্রিল মাসে মৃত্যু ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছিল।
Graph 2: অফিসিয়াল ডেটা এবং মিডিয়া রিপোর্ট এটা স্পষ্ট করে যে প্রায় তিন মাস ব্যাপী দ্বিতীয় ঢেউয়ে, মে 2021-এ সবথেকে বেশি মৃত্যু হয়েছিল। যাই হোক, বেশিরভাগ পৌরসভার ডেটা 10 মে পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রথম 10 দিনে, 2021 সালের মে মাসে 67টি পৌরসভায় 3,532জন মারা গেছে। এই 10 দিনে এই পৌরসভাগুলির জন্য প্রতিদিনের মৃত্যুর গড় 2019 সালের মে মাসের তুলনায় চারগুণ।
Graph 3: আমরা 2019, 2020 এবং 2021-এর মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে 10 টি পৌরসভার নমুনার জন্য বয়সভিত্তিক মৃত্যু বিশ্লেষণ করেছি। অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় 50 থেকে 80 বছর বয়সীদের মধ্যে সব থেকে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। 60 থেকে 70 বছর বয়সী মানুষ সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
Graph 4: অধিকাংশ পুরসভার তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। 2019, 2020 এবং 2021— এই তিনটি সালের মধ্যে যদি তুলনা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে, 2021 সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মৃত্যুহার অন্য বছর দু'টির তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
Graph 5: সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচটি পুরসভা
কোভিডে যে ভায়বহ মৃত্যুর খতিয়ান গুজরাত সরকার গোপন করেছে, শ্মশানের খাতায় তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।