×
  • নজরে
  • ছবি
  • ভিডিও
  • আমরা

  • সোমেন মিত্র

    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত | 30-07-2020

    সোমেন মিত্র (১৯৪১ - ২০২০)

    রাস্তায় বসে রাজনীতি করাটা ঠিক সোমেন মিত্র-র ধাতে ছিল না। ভাদ্র মাসের প্যাচপ্যাচে গরমে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে তিনি হাইওয়ের ধারে সত্যিই সত্যিই রাস্তায় বসে। গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার সোমেনদা, দিদি আপনাকে একেবারে রাস্তায় বসিয়ে দিয়েছে?’ কপালের ঘাম কাঁচিয়ে মুছে তাঁর জবাব, ‘রাস্তায় বসলে তোমরা এই বলবে, না বসলে আবার বলবে রাস্তায় নামল না সোমেন মিত্র।তারপরই ঠোঁটের কোণায় ঝুলোনো হাসি নিয়ে তাঁর পাল্টা ঠেস, ‘ওরে সুদীপ্তকে একটা চেয়ার দে বসার জন্য, এ কিন্তু মাটিতে বসার পার্টি না!

     

    ঘটনার স্থান হুগলি জেলার সিঙ্গুর, কাল 2008 সালের আগস্টের শেষ। পাত্র পাত্রীর মধ্যে কিন্তু সোমেন মিত্র নিতান্তই প্রান্তিক, কেন্দ্রীয় চরিত্র অবশ্যই অকুস্থলে উপস্থিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং অনুপস্থিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রতন টাটা। তৃণমূল নেত্রীর নেতৃত্বে দেড় ডজন দল তখন সিঙ্গুরে টাটাদের প্রস্তাবিত কারখানার জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে টানা ধর্না দিচ্ছে। তারই একটি প্রগতিশীল ইন্দিরা কংগ্রেস’, যার নেতা প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। মমতার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে তাঁর বাহিনীর বহুর মধ্যে একজন হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিতে সোমেনকে কতখানি মানসিক পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল, তা কল্পনা করা সত্যিই কঠিন। সেই পথের সূচনা নয়ের দশকের গোড়ায়প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্ব দখলের জন্য যখন সোমেন-মমতা বিরোধ তুঙ্গে।

     

    আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে, নয়ের দশকের গোড়ায় আনন্দবাজার পত্রিকার রাজনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে আমার কাজ ছিল কংগ্রেস কভার করা। কংগ্রেস বলতে তখন মধ্য কলকাতায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের পাশে হাজি মহম্মদ মহসিন স্কোয়ারে জরাগ্রস্ত একটি বাড়িতে প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যালয়ে অফিসিয়াল কংগ্রেস আর তার সমান্তরাল হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে টালির বাড়ির কোনায় নয় ফুট বাই ছয় ফুট ঘরে যুব কংগ্রেস নেত্রী মমতার কংগ্রেস। জন সমর্থনের বেশিটা মমতার সঙ্গে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীন বৈঠকখানার সংগঠন সোমেনের সঙ্গেএমনটাই ছিল সাধারণের ধারণা এবং সেটা মোটের উপর ভুল ছিল না।

     

    কংগ্রেসে মাঝে মাঝে গণতন্ত্র মাথা চাড়া দেয়! রাহুল গান্ধী 2014 সালের লোকসভা নির্বাচনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাইমারির ধাঁচে প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস কর্মীদের ভোটেই প্রার্থী বাছাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন। সেবার উত্তর কলকাতা থেকে সোমেন মিত্র ছাড়া আর কারও মনোনয়ন জমাই পড়েনি। ভোটের ফলে চতুর্থ হন সোমেন, বোঝা যায় কংগ্রেসের মধ্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু মানুষের মধ্যে কংগ্রেসই প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। নরসিংহ রাও যখন নয়ের দশকের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেস সভাপতি, তখনও একবার কংগ্রেসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। এআইসিসি সদস্যের দ্বারা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সরাসরি নির্বাচিত হবেন, দিল্লির হাইকমান্ডের কোনও ভূমিকা থাকবে নাএই ছিল সাধু প্রস্তাব। 1992 কলকাতায় সেই নির্বাচন হল। হাজরা মোড়ে মমতার বাড়ির অদূরে মহারাষ্ট্র নিবাস হলে সেই নির্বাচনে সোমেন-মমতার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতলেন সোমেন। জনপথের জনপ্রিয়তাকে দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হলেন মমতা। দলীয় সংগঠনের জোরে নির্বাচিত হয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির মর্যাদা পেলেন সোমেন। কিন্তু রাজ্যের বাম বিরোধী রাজনীতির সিংহাসন তাঁর হাত থেকে চলে গেল মমতার হাতে। তারও ছয় বছর পরে মমতা কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল গড়বেন, এবং আরও এক যুগ পরে বামেদের হঠিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হবেনকিন্তু সে সবই তখনও ইতিহাসের গর্ভে।

     

    অধুনালুপ্ত এবং রাজ্যের ক্ষুদ্রতম বিধানসভা কেন্দ্র শিয়ালদহ থেকে 1982 থেকে 2006 পর্যন্ত টানা ছয়বার বিধানসভায় নির্বাচিত হন তিনি, সিঙ্গুর পর্বে কংগ্রেস ত্যাগ এবং তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার পর 2009 সালে ডায়মন্ড হারবার থেকে নির্বাচিত হন লোকসভায়। তার মানে দীর্ঘ এবং জবরদস্ত ভোট মেশিনারি-সম্পন্ন বাম জমানায় তিনি সেই বিরল অ-বাম নেতাদের মধ্যে পড়েন, যাঁরা ভোটে হারেননি। প্রবল মানসিক বাধা অতিক্রম করে এবং ইগো বিসর্জন দিয়ে কেন তিনি মমতার নেতৃত্ব মেনে তৃণমূলে এলেন এবং লোকসভায় গেলেন 2009 সালে? দিল্লির রাজনীতিতে তিনি কোনও দিনই স্বচ্ছন্দ নন, আমহার্স্ট স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়ি, শিয়ালদার গলিঘুঁজি ছেড়ে ডায়মন্ড হারবারও তাঁর পছন্দের কেন্দ্র ছিল না। তবু কেন তিনি এলেন মমতাকে নেত্রী মেনে? মুখে স্বীকার না করলেও গূঢ় কারণটি তিনি অস্বীকারও করেননি সরাসরি। আমার প্রস্তাবিত তত্ত্বটি ছিল এই রকম: 2008 সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল থেকেই বিচক্ষণ সোমেন বুঝতে পেরেছিলেন বাংলায় বাম জমানার অবসান আসন্ন। সারা জীবন বাম বিরোধী রাজনীতি করা এবং বিরোধী আসনে বসা সোমেন চেয়েছিলেন পাশার দান উল্টোলে বামেরা যখন হবে হীনবল, তখন বিপরীতে শাসকের আসনে বসে তিনি তা উপভোগ করবেন। কিন্তু সেই শাসকের আসনে কোনওভাবেই কংগ্রেস আসছে না, মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসই আসছে এটাও তখন জলের মতো পরিষ্কার। অতএব যাবতীয় তিক্ততা ভোলার চেষ্টা করে এবং ইগো বিসর্জন দিয়ে মমতার নেতৃত্ব স্বীকার সোমেনের। রাজনীতিকরা সাধারণত নিজের কথাই শুনতে পছন্দ করেন, অন্যের কথা শোনেন না। সোমেন মিত্র ছিলেন নিবিষ্ট শ্রোতা। আর তত্ত্বটি মন দিয়ে শুনেছিলেন তিনি। প্রায়শই রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সরাসরি হ্যাঁ বা না বলার না থাকলে সোমেন সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতেন। অনেক সময়েই অবশ্য চোখের ভাষায় বোঝা যেত কী তিনি ভাবছেন। এ ক্ষেত্রে আমার তত্ত্বটি শোনার পর তিনি বলেছিলেন, ‘কী খাবে বলো।

     

    কী খাবএর উত্তরে সোমেন মিত্র-র সামনে মুখ ফসকে কিছু বলে ফেললে রেহাই ছিল না। কলকাতা বা দিল্লিতে তাঁর আপ্যায়নের অভিজ্ঞতা থাকবে বহু সাংবাদিকেরই। মাংস ছাড়াও অন্তত তিন রকম মাছের পদ থাকতই তাঁর মেনুতে। দিল্লিতে হলে চিত্তরঞ্জন পার্কের বাঙালি মহল্লার বাজার থেকে নিজে বেছে মাছ কেনা ছিল তাঁর প্যাশন। ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর নিজের খাওয়া দাওয়া যখন অনেক নিয়ন্ত্রিত, তখনও খাইয়ে তৃপ্তি পেতে তাঁর অসুবিধা হয়নি।

     

    নেতা হিসেবে কর্মীদের প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠ জনদের দেখতেনও পরিবারের মতো করেই। তত্ত্বের ধার না ধেরে মাঠ ময়দানের রাজনীতি করতেন, বাস্তবকে মেনে নিয়ে কৌশল ঠিক করতেন। বাম-কংগ্রেসের রাজনৈতিক লড়াইয়ে জেলায় জেলায় লাশ পড়া যখন নিত্যদিনের ঘটনা, তখন তিনি সমর্থকদের সত্যাগ্রহের পরামর্শ দেননি। কর্মীদের বলতেন, ‘কাঁদুনি গাইতে আমার কাছে আসবি না, মার খেয়ে নয়, মার দিয়ে তারপর আয়, দেখব কী করা যায়।আবার 1990 সালের কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে যখন মধ্য কলকাতা জুড়ে ব্যাপক সন্ত্রাস করে, প্রকাশ্যে গুলিগোলা চালিয়ে, পুলিশকে নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে যখন বামফ্রন্ট ভোট করল, তখন সেই রাতেই উদ্বিগ্ন সোমেন ছুটে এসেছিলেন সংবাদপত্রের দফতরে, যা তিনি কখনও করতেন না। সে রাতে তাঁর বক্তব্য ছিল, মানুষের অধিকার রক্ষায় সংবাদপত্র যদি গণতন্ত্রের এবং ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়ায়, তবে সাংবিধানিক ব্যবস্থাই সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বে।

     

    আজকে তেমন ঘটনা ঘটলে কোথায় যেতেন সোমেনদা? কোন সংবাদ মাধ্যমের কাছে গণতন্ত্র রক্ষার আর্জি জানাতেন?

     


    সুদীপ্ত সেনগুপ্ত - এর অন্যান্য লেখা


    কাদের কুলের বৌ গো তুমি, কোন খাপের গো কুলপতি?

    বাংলায় ভোটের ফলের কারণ বুঝতে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ হিন্দুত্ববাদীরা পড়ে দেখতে পারেন।

    সারা জীবন নাটক করছেন, মৃত্যুতে সযত্নে সেটাই এড়িয়ে গেলেন শম্ভু-দুহিতা শাঁওলী।

    রাজনীতি বর্জিত এমন অরাজনৈতিক নির্বাচন গত চার দশকে দেখেনি বাংলা।

    ফেসবুক পোস্টে তপতী দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে হরির কোনও ক্রনিক অসুখ ছিল না।

    সদ্যপ্রয়াত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আবেগের সুনামিতে একবারও আমাদের মনে পড়ল না অন্য কৃতীদের।

    সোমেন মিত্র-4thpillars

    Subscribe to our notification

    Click to Send Notification button to get the latest news, updates (No email required).

    Not Interested