আজকের ভারত-চিনের সীমান্ত দ্বৈরথের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে চিনা পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণের সঙ্গে এই ডাক বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু কতটা বাস্তবসম্মত চিনা পণ্য ও পুঁজি বয়কট? বিশেষ করে যখন এই মুহূর্তে করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সরঞ্জামের জন্যই ভারত অনেকটা চিনের উপর নির্ভরশীল? চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে সব সময়েই আমাদের সামরিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত করেই বিচার করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে 1962 সালের যুদ্ধ স্মরণীয়। সেই যুদ্ধে চিনা লালফৌজের হাতে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হতে হয়েছিল ভারতের সেনাবাহিনীকে। সঙ্কট নিরসনে মার্কিন-সোভিয়েত উভয় শক্তিবলয় থেকেই সচেতন দূরত্ব রাখায় প্রয়াসী নেহরুকে তাঁর সাধের জোট-নিরপেক্ষ নীতির সঙ্গে আপস করতে হয়েছিল। তৎকালীন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জন কেনেথ গ্যালব্রেথের মাধ্যমে মার্কিন সাহায্যের জন্য তদ্বির করেছিলেন নেহরু। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডিকে নেহরুর অসহায়তার দিকটা বুঝিয়ে আলাদা করে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন নেহরু-সুহৃদ গ্যালব্রেথও। নেহরুকে নিরাশ করেননি কেনেডি, যথাসাধ্য সাহায্য পাঠিয়েছিলেন ভারতকে। কিন্তু নেহরু নিরাশ হয়েছিলেন ‘প্রিয়’ প্রতিবেশি দেশটার বিশ্বাসঘাতকতায়। স্বাধীন ভারতের মাত্র দু'বছর পর আত্মপ্রকাশ করা গণপ্রজাতন্ত্রী চিন-ও যে তখন সামরিক, অর্থনৈতিক সকল মানদণ্ডে অগ্রবর্তী ছিল, এমনটা নয়। তবে, মাও-সে-তুঙের দেশ একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করলে, যুদ্ধে ভারতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারত।
এই যুদ্ধের পরে দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। আগে চিন, এক দশক পরে ভারত। 1964 খ্রীষ্টাব্দে চিন প্রথম সফল পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটায়। একইসময় ভারতেও পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য ব্যাপক দাবি উঠলেও, প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং দেশের পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা তাতে মত দেননি। এর দশ বছর পরে, 1974 সালে দেশের বিজ্ঞানীদের অনুরোধে, ঘরোয়া রাজনীতিতে চাপে থাকা ইন্দিরা গান্ধী পোখরানের বালুচরে দেশের প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর 1998 সালের 11 মে (পোখরান-2) অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার আরও শক্তিশালী পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে সাফল্য অর্জন করে। এর মধ্যে ছিল থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস বা হাইড্রোজেন বোমা, যার বিধ্বংসী ক্ষমতা হিরোসিমায় ব্যবহৃত বোমার হাজার গুণ। চিন আগেই এই ক্ষমতা অর্জন করেছিল। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দী শুরু হওয়ার আগেই দুই দেশই সর্বোচ্চ পারমাণবিক শক্তির অধিকারী।
সম্প্রতি ভারত ও চিনা সৈন্যদের মধ্যে গালওয়ান উপত্যকায় হওয়া সংঘাতের পর ভারতে চিনা পণ্য বয়কটের আহ্বানকে এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। সোশাল মিডিয়া, এমনকী রাস্তাঘাটে পোস্টার সেঁটেও এখন চিনা পণ্য বয়কটের আহ্বান (কখনও হুমকিও) করা হচ্ছে। কিন্তু এই অবিমিশ্র ‘দেশপ্রেম’ দেখেও মনে প্রশ্ন জাগে, চিনা পণ্যের গুদামঘর হয়ে বসে থাকা এই দেশে আদৌ এই আহ্বান কতটা বাস্তবসম্মত? এত বিপুল বাজারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর মতো ‘আত্মনির্ভরশীল’ আমরা হতে পেরেছি তো? 2015 সালে দেশে চিনা পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল 6,159 কোটি টাকা, যা মোট আমদানির 15.7 শতাংশ। 2019-এ ভারতের আমেরিকা-নৈকট্য চিন নির্ভরতায় যৎসামান্য রাশ টানতে পেরেছে। এখন সেদেশ থেকে মোট আমদানির পরিমাণ 6,861 কোটি টাকার, যেটা মোট আমদানির 14.31 শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে চিনা দ্রব্য ব্যতীত আমরা কতটা নিজেদের জিনিসের উপর নির্ভর করতে পারি? চিন সারাবিশ্বে নানা পণ্য এবং কাঁচামাল রপ্তানি করে থাকে। ই-কমার্স সাইটগুলিতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি কিংবা মুসলমানদের বাহারি জায়নামাজ থেকে শুরু করে খেলনা, মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ-সহ দৈনন্দিন ব্যবহার সামগ্রীর কী না পাওয়া যায় সেখানে? ওই পণ্যসম্ভারের একটা বড় অংশই চিনের উৎপাদন। শুধু খেলনা, মোবাইল বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক দ্রব্যের যন্ত্রাংশই নয়, গাড়ি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বয়লার বা পরমাণু বিদ্যুতের রিঅ্যাক্টর— সব ক্ষেত্রেই চিন সহায়। এমনকী জীবনদায়ী জরুরি ওষুধের ক্ষেত্রেও আমরা অনেকটাই চিনের উপর নির্ভরশীল।
শুধু চিনা পণ্য নয়, চিনা পুঁজির বিষয়টিও এখানে আলোচনার দাবি রাখে। এই দেশের নতুন স্টার্ট-আপ গুলির অন্তত দুই-তৃতীয়াংশে চিনা বিনিয়োগ রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে চিনের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি এদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি করছে। উল্টোদিকে চিনের বাজারে ভারতের লগ্নি এর তুলনায় প্রায় অকিঞ্চিৎকর। দেশীয় উদ্যোগপতিরা মূলত দেশের প্রাকৃতিক সম্পদনির্ভর পণ্য সে দেশে রপ্তানি করছেন। চিন কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে কঠোর নিয়মকানুন অনুসরণ করে, রফতানি করে উপভোক্তার কাছে বিক্রয়যোগ্য পণ্য (ফিনিশড প্রোডাক্ট)। সেখানেও ভারসাম্যের একটা অভাব রয়েছে। তবে বাণিজ্যের যুক্তির চেয়েও আপাতত আবেগই ভারতের বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠন এখন বলছে যে তারাও এবার চিনা পণ্য বিক্রি বন্ধ করবে।
খুচরো পণ্যের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ব্যাপার মন্ডল’-এর সাধারণ সম্পাদক ভিপিন বনসলের বক্তব্য, “ভারতীয় সৈনিকদের মৃত্যুতে সারা দেশেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে। আমরাও ভারতেরই নাগরিক। তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা কেউই চিন থেকে পণ্য আমদানি করে সেদেশের অর্থনীতিতে সহায়তা করতে রাজি নই।" চিন থেকে বছরে 7,400 কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে খুচরো ব্যবসায়ীরা। তাঁর বক্তব্য, আপাতত চিনা পণ্য যা মজুত আছে, সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হবে; কিন্তু নতুন করে কোনও অর্ডার দেওয়া হবে না। পশ্চিমবঙ্গের খুচরো ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘কনফেডারেশন অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রেডার্স এসোসিয়েশন’-ও চিনা পণ্য বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তারা বলছে, অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি এখনই বন্ধ করা হয়ত যাবে না। করোনার বিরুদ্ধে জেতার জন্য যত রকম সরঞ্জাম দরকার তা মূলত চিন থেকেই আসে। অতএব চিন নির্ভরতা কাটাতে হলে ভারতকে এমন কৌশল প্রয়োগ করতে হবে যা হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং সুপরিকল্পিত।
সেটা রাতারাতি সম্ভব হবে না। ভারতকে স্বনির্ভর হতে হলে স্বল্প ব্যয়ে কাঁচামাল সরবরাহ করতে হবে এবং সেটা ব্যবসায়ীদের কাছে সুলভে পৌঁছে দিতে হবে। বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার নিয়মবিধি অনুসারে ভারত চিনা পণ্যের জন্য এ দেশের বাজারকে বন্ধ করে দিতে পারবে না। আর এই নব্য পুঁজিবাদী সময়ে পুঁজির চলাচলকে এভাবে রুখে দেওয়ার চেষ্টা হলে নিজেদের অক্ষমতাই প্রকট হবে, বিশ্ব বানিজ্যে একঘরে হয়ে যাবে ভারত। তাই গুণগত মানে খুব বেশি আপস না করেও সুলভমূল্যের চিনা পণ্যগুলির সঙ্গে টক্কর দিতে হবে দেশীয় উৎপাদনগুলিকে।
এই পরিস্থিতিতে আমরা যদি আমাদের সীমাবদ্ধতাকে অস্বীকার করি, আমরা কি আদৌ ড্রাগনের রক্তচক্ষু দেখানোকে বন্ধ করতে পারব? তাই, আবেগবর্জিত হয়ে কঠিন বাস্তবকে মেনে নিয়েই আমাদের পড়শি দেশের আস্ফালন ও একাধিপত্যকে বন্ধ করতে হবে। না হলে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়ার আহ্বান সারগর্ভহীন একটা রাজনৈতিক উক্তি হিসাবেই থেকে যাবে।
খেলনা বা মোবাইল নয়, গাড়ি থেকে শুরু করে পরমাণু বিদ্যুতের রিঅ্যাক্টর— সব ক্ষেত্রেই চিন সহায়।