বেশ চলছিল সব, ছাত্রছাত্রীরা ইস্কুলে ফিরছে, ঘরে বসে কাজ করা-রা অফিসে, বিয়ে বাড়ি, পুজো বাড়ি গমগম করছে, রবীন্দ্র জয়ন্তীর রিহার্সাল চলছে- এর মধ্যে সাগরপার থেকে এ কী উৎপাত! কি না ওমিক্রন variant XE ঢুকে পড়েছে ভারতে! বহির্বিশ্বে আরও নাকি কী সব ভেরিয়েন্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে।
XE নিয়ে চিন্তিত হব কিনা বলার আগে শুরু করি ওমিক্রনের গল্প থেকে। গত ডিসেম্বরে ওমিক্রনের আতঙ্ক শুরু হওয়ার সময় যে প্রতিবেদনটি লিখেছিলাম সকলকে আশ্বস্ত করে, তারপরে ওমিক্রন সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা গেছে। আবার অনেক কিছু আজও জানা যায়নি। সিক্যোয়েন্স, সিকোয়েন্সিং এইসব শব্দ এখন সবারই চেনা। 2020-র মাঝামাঝি থেকেই সারা পৃথিবীতে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, মাঝে মধ্যেই RTPCR টেস্ট করতে আসা কিছু কিছু স্যাম্পলকে সিকোয়েন্সিং করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু ভাইরাস মাত্রেই মিউটেশন প্রবণ, অর্থাৎ হঠাৎ হঠাৎ তাদের রূপ পরিবর্তনের প্রবণতা আছে, তাই SARS-Cov2 ভাইরাসের কোথায় কোথায় নতুন মিউটেশন গজাল, তা নজরদারি করা যায়। এইভাবে গতবছরে নভেম্বরের শেষ দিকে হঠাৎ একটি সিক্যোয়েন্স নজরে এল, যাতে প্রথম যে SARS Cov2 সিক্যোয়েন্স পাওয়া যায় 2019 সালে, তার তুলনায় 50টি নতুন মিউটেশন আছে। এই মিউটেশন গুলির মধ্যে 30টা-ই আবার এস অর্থাৎ স্পাইক প্রোটিনের মধ্যে। সবার শোনা থাকলেও আবার বলি, এই স্পাইক প্রোটিন হল করোনা ভাইরাসের বাইরের খোলার গায়ে একটি কাঁটার মতো বস্তু, যা রোগীর শ্বাসনালীর দেওয়ালের কোষে বিঁধে গিয়ে সংক্রমণ শুরু করে। কোভিডের টেস্ট, ওষুধ, ভ্যাকসিন সবাই প্রায় এই স্পাইক প্রোটিনের সিক্যোয়েন্স ব্যবহার করেই বানানো হয়। কাজেই অতগুলো মিউটেশন অবশ্যই চিন্তার ছিল দু’টি কারণে। এক হল, কাঁটায় মিউটেশন হওয়া মানে কাঁটার চেহারা পাল্টে যাওয়া- অর্থাৎ কিনা শ্বাসনালীর মধ্যে ভাইরাস আগে যেভাবে আটকাতে বংশবৃদ্ধি করত এবং শরীরের অন্য অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে অসুখ বাঁধাত, সেই কর্মপদ্ধতি পাল্টে যাবে। পাল্টে আরও সাংঘাতিক হবে কি? দুই হল, এত কষ্ট করে বানানো ভ্যাকসিন কাজ করবে কিনা।
চিন্তার কারণে এই বিশেষ মিউট্যান্টকে আর কোভিড মিউট্যান্টদের যে সাধারণ পদ্ধতিতে নামকরণ করা হয়, অর্থাৎ B.1.1.529, তার থেকে বেরিয়ে বিশেষ তকমাওয়ালা নামকরণ করা হল "ওমিক্রন'!
চিন্তা এবং আতঙ্কের অংশটা এখন ইতিহাস। যে ওয়েভটা ওমিক্রনের কারণে ঘটেছে বলে ধরা হয়, সেখানে আমাদের দেশে, আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসেবে আগের ওয়েভগুলির চেয়ে অনেক বেশি, কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা আগের ওয়েভের চেয়ে অনেকই কম, অনেক শতাংশের কম তো বটেই। আমরা সবাই জানি ঠিক কতজন তখন আক্রান্ত হয়েছিল, তার কোনও হিসেব নেই, কারণ গোটা কলকাতায় বাদ গেছে এমন লোক হয়তো নগণ্য। হাসপাতালে যেতে হয়েছিল অনেক কম মানুষকেই। কিন্তু ভ্যাকসিন কাজ করে রোগের তীব্রতা কম হল, না মিউটেশনের কারণে ভাইরাস দুর্বল হল, সেই প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি।
আরও একটা বিরাট প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। মিউটেশন ঘটে ধাপে ধাপে, মাসে একটি দু’টি করে। সেখানে এক লাফে লোকচক্ষুর আড়ালে 50টা মিউটেশন সংবলিত একটা ভেরিয়েন্ট হঠাৎ তৈরি হল কী করে? WHO-র নব গঠিত কমিটি Scientific Advisory Group for the Origins of Novel Pathogens (SAGO)-র ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিষয়ে আলোকপাত করার কথা ছিল। কিন্তু আমি অন্তত এখনও এদের কোনও রিপোর্ট দেখতে পাইনি। বরং, জানুয়ারির শেষে নেচার পত্রিকায় এই বিষয়ে তিনটি তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে:
1) কোনও রোগী যখন অনেকদিন ধরে কোনও ভাইরাল বা সংক্রামক রোগে অসুস্থ থাকে, তখন তার শরীরের মধ্যেই ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে বহুদিন ধরে, এবং দ্রুত বহু মিউটেশনের জন্ম দেয়। HIV -র ক্ষেত্রে এটা দেখা গেছে, কাজেই হয়তো কোভিডের ক্ষেত্রেও এটা সম্ভব। কোনও বিশেষ রোগী, হয়তো কম প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগীর শরীরেই প্রথম ওমিক্রন ভাইরাসের সূচনা হয়, তার থেকে বাকিদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
2) হয়তো মানুষ থেকে অন্য কোনও পশুতে, যেমন ইঁদুরে হয়তো সংক্রমণ ঘটেছিল। ইঁদুরের বংশবৃদ্ধির হার যেহেতু অনেক বেশি, তাই সেখানেই দ্রুত গতিতে ভাইরাসের অনেক অনেক বার বংশবৃদ্ধির সুযোগ ঘটেছে এবং মিউটেশনের-ও। তারপর ইঁদুর থেকেই ফেরত এসেছে মানুষে।
3) সারা পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত মাত্র 10 মিলিয়ন সিকোয়েন্সিং করা গেছে, যেখানে নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা 500 মিলিয়ন অর্থাৎ মাত্র 2শতাংশ কেস সিকোয়েন্স করা গেছে। এর মধ্যে আবার কোনও কোনও দেশ বেশি সিকোয়েন্সিং করেছে। তা-ও সংখ্যাটা শতাংশের বেশি নয়। অন্য অনেক দেশে আরও কম, শতকরা হার হিসেবে খুবই কম। এমন হতেই পারে, যেসব দেশে কেস বেশি, কিন্তু সিকোয়েন্সিং খুব কম করা হয়েছে, সেখানে অলক্ষ্যে মিউটেশন জমেছে। তারপর ভ্রমণের কারণে ছড়ানোর পর প্রথম ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কৃত হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকাতেই। আর একটা চমকপ্রদক তথ্য হল ওমিক্রনের তিনটি প্রজাতি BA.1,BA.2 ও BA.3প্রায় একই সময় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আবিষ্কৃত হয়েছে এবং যার নাম দেওয়া হয়েছে BA.2, তার সিকোয়েন্স পাওয়া গেছে আগে। হইচই ফেলা, চিন্তা ও আতঙ্ক ছড়ানো ভ্যারিয়েন্ট, ওমিক্রন নাম পেয়েছে যেটি, সেটির সিকোয়েন্সিং পরে হয়েছে। একাধিক প্রজাতির অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর BA.1 ইত্যাদি নামকরণ চালু হয়েছে। এখন তো BA.4এবং BA.5 নামধারী আরও নতুন প্রজাতি পাওয়া গেছে।
এই প্রসঙ্গে কয়েকটা কথা না বলে পারছি না। সরকারি মতে ভারতে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা 4.3 কোটি। ভ্রমর মুখার্জির তত্ত্ব ধরলে এর 10 থেকে 50 গুণ বেশি হওয়া উচিত আসল সংখ্যা (মৃত্যুহার-ও ঠিক অত গুণই বেশি হওয়ার কথা, এবং সেখানে লুকোছাপার একটা বিরাট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে)। সেখানে আজ পর্যন্ত সিকোয়েন্সিং হয়েছে মাত্র এক লক্ষ দশ হাজার। তত্ত্বগত ভাবে ভারতে কিন্ত প্রচুর মিউটেশন গজানোর কথা। কিন্তু শতকরা হিসেবে ভারতে এতই কম সিকোয়েন্সিং হয়েছে যে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় সব ভেরিয়েন্ট-ই যেন আমদানি হয়ে এসেছে। সবাই মুখে মুখে বলে "ডেল্টার সময়ে…' , কিন্তু গত বছরে এপ্রিল মে-র মৃত্যু উপত্যকা পার হওয়ার সময়ে সিকোয়েন্সিং হয়ে থাকলেও সেটা একেবারেই নগণ্য সংখ্যক। বাস্তবে তার অনেক কারণও আছে: 1) লকডাউন, 2) বিজ্ঞানী ইত্যাদিদের অনেকে নিজেরাই অসুস্থ 3) যে সব রাসায়নিক কাঁচা মাল বা রিয়েজেন্ট হিসাবে লাগে, সেগুলির ফুরিয়ে যাওয়া। সিকোয়েন্সিং-এর হিসেব পাওয়া যায় আবার জুন থেকে, যদিও সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যায়। বিজ্ঞানের নজির আছে প্রচুর বংশ বৃদ্ধি হলে যেমন প্রচুর মিউটেশন সৃষ্টি হয়, আবার পরিস্থিতি অনুকূল না হলে যেমন ভাইরাসের "হোস্ট' যাকে বলে, অর্থাৎ মানুষ, পশু ইত্যাদি যারা সংক্রমিত হয়, তাদের মৃত্যুহার বেড়ে গেলে সেই মিউটেশন অদৃশ্যও হয়ে যেতে পারে। ডাক্তারদের অনেককেই বলতে শুনেছি "অমুক শহরে বেশি মরছে, স্ট্রেইন টা বোধহয় আলাদা'। মৃত্যুহারের তফাতের পিছনে পরিকাঠামোর তফাৎ অবশ্যই কাজ করে, কিন্তু জীবাণু-বিষাণুর ক্ষেত্রে মিউটেশন বা স্ট্রেইন-এর তফাৎ-এর সম্ভাব্য ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। সরকারের জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ, যারা এইসব সিকোয়েন্সিং-এর তত্ত্বাবধায়ক, তাদের ওয়েবসাইটে “Myths and facts”-এ লেখা আছে, “রটনা হয়েছে যে ভারতে খুব কম সংখ্যক সিকোয়েন্সিং হয়েছে।” উত্তর হিসেবে বলা হয়েছে, “সরকারের নীতি এবং WHO-র পরামর্শ অনুসারে সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে।” কাজেই ভারতের পক্ষে অনেক অজানা মিউটেশনের উৎসস্থল হওয়া এবং ওমিক্রনের 50টি মিসিং মিউটেশনে অবদান রাখার সম্ভাবনা প্রবল।
XE বলছে ওমিক্রনের দুটো ভেরিয়েন্ট BA.1 এবং BA.2-র recombination হয়ে তৈরি হয়েছে? এতে নাকি BA.1 এবং BA.2 দুয়েরই বৈশিষ্ট্য বর্তমান, এবং এটি নাকি এই দুই স্ট্রেইনের চেয়েও বেশি ছোঁয়াচে, তবে বেশি মারাত্মক কিনা বলা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারটা কী?
জিন অর্থাৎ DNA বা RNA-র ধরনই হল আর একটি DNA বা RNA পেলে তার সঙ্গে জোড় বেঁধে নিজেদের সিকোয়েন্স বিনিময় করা। এ ঘটনা প্রতিনিয়ত চলে। দুটি DNA বা RNA পরস্পরের থেকে পৃথক সিকোয়েন্সের হলেই তখন এই বিনিময় নজরে আসে। এই বিনিময় জীবন্ত কোষের মধ্যে বা কোষের অনুকরণে তৈরি টেস্ট টিউব বা পিটরি প্লেটের মধ্যে ঘটতে পারে। এক সঙ্গে দু’রকম ভাইরাসের সংক্রমণ হলে তাদের জিন বিনিময় বা রিকম্বিনেশন হতে পারে। এখন চতুর্দিকে যে সব নানা রকম করোনা ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে রিকম্বিনেশন হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনকি মনে করা হয়, সাধারণ সর্দির যে করোনা ভাইরাস, ওমিক্রনের একটি প্রজাতিতে তারও সঙ্গে রিকম্বিনেশন হয়েছে। BA.1-এ নয়টি অ্যামাইনো অ্যাসিডের একটি বিশেষ সিকোয়েন্স নাকি তারই চিহ্ন। XE যেমন BA.1 এবং BA.2-র রিকম্বিনেশন এ তৈরি হয়েছে সেই রকম, XD এবং XF তৈরি হয়েছে ডেল্টা এবং BA.1-এর বিভিন্ন কম্বিনেশনের রিকম্বিনেশনে। যেমন বলেছি, রিকম্বিনেশন অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা, ঠিক যেমন মিউটেশন। কাজেই নতুন ভেরিয়েন্টের তালিকা লম্বা হবে এবং এটার জন্য প্রস্তুত থাকতেই হবে।
XE-র জন্য চিন্তিত থাকব কি? একটা আশার কথা জানা গেছে যে, ওমিক্রনের একটি ভেরিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হলে অন্য ভেরিয়েন্টের জন্য কিছুটা অন্তত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আর একটা কথা BA.1 এবং BA.2 র মধ্যে BA.2 বেশি প্রবল। কলকাতায় গত ডিসেম্বর, জানুয়ারিতে BA.2 -র প্রাধান্য ই ছিল। কাজেই একটু আশাবাদী তো হতেই পারি যে, যারা ওমিক্রনে সংক্রমিত হয়েছিলেন, তাঁরা এই মুহূর্তে হয়তো নিরাপদ। তাছাড়া বুস্টার ডোজ তো দেওয়া চলছেই।
আবার সেই প্রশ্নে ফিরে আসি, ভ্যাকসিন কি কাজ করছে? একটা কথা মনে রাখতে হবে। ভ্যাকসিন যে স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই স্পাইক প্রোটিন কর্মক্ষম আছে, অর্থাৎ সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম আছে, ততক্ষণ ভ্যাকসিনের অন্তত কিছুটা গুণ থাকবেই প্রতিরোধ করার। কোভিডের কোনও ভ্যাকসিন সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত বলা হয়নি, যে তারা সংক্রমণ প্রতিরোধ করবে। বলেছে রোগের তীব্রতা প্রতিরোধ করবে এবং মৃত্যুহার কমাবে। এর চেয়ে বেশি ভবিষ্যৎবাণী এই মুহূর্তে না করাই ভাল। আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে। আরও নতুন মিউটেশন অর্থাৎ ভেরিয়েন্ট আসার জন্য। হয়তো নতুন ওয়েভ আসতেই পারে অদূর ভবিষ্যতে।
(ড: সুস্মিতা ঘোষ বায়োটেক স্টার্টআপ ডায়াগনোরাইটের প্রতিষ্ঠাত্রী, আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ কানেটিকাট থেকে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস-এর ডক্টরেট)
হয়তো নতুন ওয়েভ আসতেই পারে অদূর ভবিষ্যতে, আমাদের প্রস্তুত থাকতেই হবে।